মরার আগে মরণ যন্ত্রণা

 

 

 


 


 

মরার আগে মরণ যন্ত্রণা

 


রিপোর্টগুলো দেখে ডাক্তার যখন বললো, আমার ক্যান্সার হয়েছে আর খুব বাজেভাবে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আমি বেশ অবাকই হলাম!
পাশে বসে থাকা আমার স্ত্রী শ্রাবণী মরা কান্না জুড়ে দিলো! ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে ডাক্তারকে বললাম- কি বলেন ডাক্তার সাহেব!
আমার শরীরে এতো বড় একটা অসুখ, অথচ আমি টেরেই পেলাম না, এমনটা তো হতে পারে না! রিপোর্টগুলো আরেকবার একটু ভালো করে দেখুন, হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে!

ডাক্তার সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললো
- "১২ বছরের ডাক্তারি জীবনে আমার কোনদিন ভুল হয়নি! আর আপনি বলছেন আমি ভুল বলছি!"

আমি তখন বললাম- তাহলে হয়তো রিপোর্ট ভুল এসেছে।

ডাক্তার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
- "রিপোর্ট ভুল হবার কোন চান্সই নেই। এই শহরে আমাদের ক্লিনিকই সবচেয়ে ভালো ক্লিনিক।
আপনি যদি আমেরিকাতেও গিয়ে টেষ্ট করান, রিপোর্ট এটাই আসবে! বলতে খারাপ লাগছে, আপনার হাতে আর বেশি সময় নেই!"

একথা শুনে শ্রাবণীর কান্না আগের তুলনায় দ্বিগুন বেড়ে গেলো! আগে তো ধমক দিয়ে কান্না থামাতে পেরেছিলাম, কিন্তু এবার ধমকে কাজ হলো না।
সামান্য সর্দি-কাশি আর গায়ে হালকা ব্যাথা ছিলো বলে শ্রাবণী আমাকে এক প্রকার জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছিল। এসে তো পড়লাম এক মহাবিপদে!

বাসায় এসে শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে মা-বাবাকে আমার ক্যান্সারের কথা বলে ফেললো।এ কথা শুনে মরার আগেই পরিবারের সবাই আমাকে ধরে মরা কান্না জুড়ে দিলো!
অথচ একটা বিষয় কোনভাবেই আমার মাথায় ঢুকছিল না, এতো বড় একটা অসুখ শরীরে বাসা বেঁধেছে, অথচ আমি শরীরে এর কোন লক্ষণই দেখছি না!
 
রাতে শ্রাবণী আমার কাছে এসে কফির মগটা আমার হাতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো
- "তোমার কি কি খেতে মন চায় আমাকে বলো! আমি তোমাকে সব রান্না করে খাওয়াবো!"

রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
- এসব কান্নাকাটি বন্ধ করে বলো, রিপোর্টগুলো কোথায় রেখেছো! এইগুলো আমাকে একটু দাও।

শ্রাবণী রিপোর্টগুলো না দিয়ে বরং কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত ধরে বলতে লাগলো
- "তুমি আমার স্বামী। তোমার এই পরিস্থিতে তোমাকে কিছু সত্যি কথা না বললেই না! রোমান্টিক অবহাওয়াতে তুমি যখন আমায় কাছে টানতে তখন আমি তোমায় বলতাম,"আমার শরীর খারাপ লাগছে" বিশ্বাস করো আমার শরীর খারাপ লাগতো না আসলে ফরজ গোসল করতে হবে সেই আলসেমিতে তোমার কাছে যেতাম না। কয়েকদিন আগে তোমার কলিগ অর্পিতাকে যে বোরকা পড়া মহিলা নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলো সেই মহিলাটা ছিলাম আমি? তোমার সাথে দাঁত বের করে হেসে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছিলো সেটা আমার সহ্য হয় নি তাই ওর নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আরেকটা কথা, তুমি যখন আমায় বকাঝকা করতে তখন আমি তোমার রাগ কমানোর জন্য তোমায় এককাপ কফি বানিয়ে দিতাম। আসলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই কফিতে আমার থুথু মিশাতাম।"

কথাটা শুনার পর আমি যখন কফির মগের দিকে তাকালাম তখন শ্রাবণী বললো,
- "বিশ্বাস করো আজ কফিতে থুথু দেই নি"
   
আমি রাগে হাতটা সরিয়ে বললাম
-তাই বলে আমাকে থুথু খাওয়াবে? এখন সামনে থেকে যাবে, নাকি গাল লাল করে দিবো!

 শ্রাবণী চোখের পানি নাকের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো…

সকাল শুরু হতেই আমার উপর এক প্রকার অত্যাচারই শুরু হয়ে গেলো! ফলমূল নিয়ে সকল আত্মীয়-স্বজন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসতে লাগলো !

ছোট বোন বাসায় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- "সোনা ভাই আমার, তোকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচবো?"

বিরক্ত হয়ে বললাম,
- এখন যেভাবে বেঁচে আছিস, সেভাবেই বেঁচে থাকবি! বিয়ের পর তো ভাইয়ের একটা খোঁজও নিস নি।

 ছোট বোন কান্না বন্ধ করে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে রইলো।
 
মাছ ব্যবসায়ী ছোট বোনের স্বামী মাথা নিঁচু করে আমায় বললো,
-" ভাইজান, আপনার কি কোন মাছ-টাছ খেতে ইচ্ছে করছে? ইচ্ছে করলে আমাকে বলুন। যেভাবেই হোক আমি সেটার ব্যবস্থা করবো!"

আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মুচকি হেসে বললাম
- আমার তিমি মাছ খেতে ইচ্ছে করছে! তুমি কি ব্যবস্থা করতে পারবে?

এইকথা শুনে ছোট বোনের স্বামী মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে বোনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
এসব ড্রামা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যখন সোফাই বসলাম, তখন এলাকার ছোট ভাই সোহাগ এসে আমার হাত ধরে বললো,
- "ভাই, আমি জানি আপনি শ্রাবণী ভাবীকে নিয়ে খুবই চিন্তায় আছেন! আপনার চিন্তা করার কোন দরকার নেই। আপনি শান্তিতে মরে যান। আপনি মারা যাবার পর আমি শ্রাবণী ভাবীর দায়িত্ব নিবো। আপনি যদি ভাবীকে আগেই একটু বলে রাখতেন, তাহলে সুবিধে হতো। বিশ্বাস করেন, আমি ভাবীকে আপনার চেয়েও বেশি সুখে রাখবো!
 
এমনিতেই মেজাজ খারাপ, তার উপর এমন কথা শুনলে কার না মেজাজ খারাপ হবে? কত্ত বড় হারামি আমি বেঁচে থাকা অবস্থাতেই আমার বউ নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। আমি সোহাগের পেছনে লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিলাম…
 
সবশেষে শুরু হলো মায়ের অত্যাচার, মা কাঁদতে কাঁদতে বললো- "বাবারে, তোর কি কোন বাজে নেশা ছিলো? তুই ক্যান্সার বাঁধালি কিভাবে?"

আমি তখন বললাম- হ্যাঁ মা, আমি সব ধরনের নেশা একত্রে পেস্ট করে সকালে সেটা দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতাম!

এসব সার্কাস দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো, আমার যদি ক্যান্সার হয়েও থাকে, তাহলে আমি ক্যান্সারে মরবো না, এদের অত্যাচারে মরবো! আমার পরিবারের লোকজন আমাকে রিপোর্টও দেখায় না, বাসা থেকে বেরও হতে দেয় না!

একদিন রাতে সুযোগ বুঝে রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম, নতুন এক ডাক্তার দেখালাম। উনি আমাকে নতুন করে সব টেষ্ট করতে বললেন।
আর রিপোর্টগুলো দেখে জানালেন-আমার কিছুই হয়নি! আগেরগুলো ভুল রিপোর্ট ছিল!

 আমি তখন ভাবতে লাগলাম, এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামে আমি মামলা করবো মরার আগেই আমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করানোর জন্য।

বাসায় আসতেই শ্রাবণী আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
-"তুমি আমায় কিছু না বলে কোথায় গিয়ে ছিলে"
আমি কিছু না বলে শ্রাবণীর দিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকালাম। শ্রাবণী তখন বললো,
-" জানো আজ শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। মনে হয় জ্বর আসবে।"

কথাটা শুনে আমি যখন চোখগুলো বড়বড় করে তাকালাম তখনি শ্রাবণী আমতা আমতা করে বললো,
- " না আমি একদম ঠিক আছি। দাড়াও আমি লাইট অফ করে আসি"

একটা বিষয় প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, আমরা সামন্য কিছু টাকা বাঁচাতে কিংবা ডাক্তারের সাজেস্ট করা খুব সাধারণ মানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাই। ফলে প্রায় সময় ভুল রিপোর্ট আসে।
যেখানে নামি-দামী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল রিপোর্ট আসার তথ্য আছে, সেখানে সাধারণ ডায়গানস্টিক সেন্টারে ভুল রিপোর্ট আসা একেবারেই স্বাভাবিক। তাই টেস্ট করানোর আগে সবারই সতর্ক থাকবেন

Post a Comment

Previous Post Next Post