প্র‍তিটি মানুষের জীবনে মায়ের প্র‍য়োজনীয়তা অপরিহার্য



 

 প্র‍তিটি মানুষের জীবনে মায়ের  প্র‍য়োজনীয়তা অপরিহার্য

 

ওগো শুনছো?  বড় থেকে একটা রুই মাছ এনো তো,  আমার মা আসবে তার রুই মাছের মাথা বড্ড প্রিয়।" কথাগুলো সেরে জলদি শাড়ির আঁচল কোমরে বেঁধে রান্নাঘরে চলে গেলো সাবিহা।

আজ অনেক কাজ সাবিহার,তার মা আসবে অনেক বছর পর। সাবিহার কথা শুনে তার স্বামী হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলো মাছ আনতে।

গোয়াল ঘরের পাশে ছোট্ট রুমে সাবিহার অন্ধ শাশুড়ী শুয়ে আছে।একটু পর পর কাঁশছে। সাবিহা বড্ড বিরক্তি নিয়ে রুমে ঢুকে তার শাশুড়ীকে বলছে
 "চোখ তো খেয়েই নিয়েছো৷ কবে আমাদের জীবন খেয়ে নাও সেই ভয়ে আছি৷ শুনো, রাতে ছেলে আসলে কোনো মায়াকান্না করবে না। তোমার রোজ রোজ জ্বালাতন আমি সহ্য করতে পারবো না বলে দিলাম। বেশি কাঁশি পেলে মুখে কাপড় দাও,আওয়াজ যেনো না আসে আমার মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যাবে"

হনহন করে কথাগুলো সেরে চলে গেলো সাবিহা। অন্ধ শাশুড়ী ছেড়া কাথায় মাথা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডুকরে উঠে কান্নায়। কান্নার আওয়াজের বেগ সামলাতে না পেরে মুখে হাত দেয়।

দুপুর বেলা সবাই খেতে বসেছে,সাবিহা তার মায়ের প্লেটে রুই মাছের মাথা তুলে দিয়ে হাতপাখা করছে আর বলছে "খাও মা খাও। অনেকদিন পর তোমাকে পেয়েছি। আজ কিন্তু সবটা খেয়েই তোমাকে উঠতে হবে"

মেয়ের আবদার ভালোবাসা দেখে খুশিতে গদগদ করছে সাবিহার মা।

সাবিহার স্বামী ফারুক, সাবিহাকে বলছে "মাছ তো দুটো এনেছিলাম। আরেকটা মাছের মাথা কই?"

সাবিহা খানিকটা ভেঙ্গছি কেটে বলে "সব যদি একদিন'ই রান্না করি তাহলে সংসার উচ্ছনে উঠে যাবে,আরেকটা কাল রাঁধবো মায়ের জন্য"

ফারুক গম্ভীর গলায় সাবিহাকে উওর দেয় "আরেকটা মাছের মাথা আমার মায়ের প্রাপ্য৷ তুমি কেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেনা, মাকে কি দিয়ে খেতে দিয়েছো? দু'টো মাছ দু'জনের জন্যই এনেছি আমি। দরকার হলে কাল আবার আনতাম।"

"বারেহ সংসারের গিন্নি আমি আমাকেই বুঝতে দাও। যা দিনকাল পরেছে কবে না খেয়ে থাকা লাগে তার কোনো ঠিক নেই। তোমার মাকে মাছ দিয়েই ভাত মেখে দিয়েছি। চিন্তা করোনা। মাছের মাথা  এমনিতেও খেতে পারবেনা অন্ধমানুষ" ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে কথাগুলো বলে মায়ের প্লেটে তরকারি তুলে দিচ্ছে সাবিহা।

ফারুক ঝগড়া না করে খাবার ছেড়ে মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। অন্ধ মা না খেয়ে খাবারের প্লেটে আঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছে আর কাঁদছে। ফারুক কাছে এসে মায়ের কাঁধে হাত রাখতেই তার মা বলে উঠে
" বাপজান এই ভাতডা আঢা আঢা (আঠা)লাগে ক্যান। ডাল রানছে আইজ?"

ফারুকের সামনে তার মা কাঁপা কাঁপা হাতে ভাতের লোকমা তুলে দেয়৷  ফারুকের নাকের কাছে লোকমা আসতেই ফারুক নাক চেপে ধরে গন্ধে।

ফারুক খেয়াল করে দেখে ভাতের সাথে মুরগির বিষ্ঠা মেশানো। ফারুক খাবারের প্লেট মাঠিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। ফারুকের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে, নিজের প্রতি বড্ড রাগ হচ্ছে তার৷

ফারুকের প্রশ্রয়ের কারণে আজ সাবিহা এতদুর এসেছে। ফারুক যেই না উঠতে যাবে তার আগেই ফারুকের পা ধরে ফেলে তার মা,সাবিহাকে বাঁচানোর জন্য ফারুককে বলে "বাপজান আমি তো কানা। আমি দেহিনা,হের লাইজ্ঞা কিতার লগে কিতা মিশাইয়া লাইছি বুঝতাম ফারিনাই। তুই বউরে কিচ্ছু কইস না৷বউয়ের দুষ নাই।"

ফারুক সবটা জেনেও মায়ের কথায় সাবিহাকে দুপুরে কিছু বলে না,ব্যপারটা হজম করে।

রাতের বেলা সাবিহাকে তার মা ফুসুরফাসুর করে বলছে "আইজ রাত এই কানিডারে পানিত ভাসাইয়া দেওন লাগবো।"

রাতে সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে,এমন সময় সাবিহা তার স্বামীকে বলে
" বারান্দায় বড় একটা বালিশ আছে ভেতরের তুলো গুলো পঁচে গেছে,ওটা নদীতে এখন ফেলে দিয়ে আসলে ভালো হয়। ঘরটা খুব গন্ধ গন্ধ লাগছে "

ফারুক সাবিহার কথামতো বারান্দা থেকে বড় একটা বস্তা কাঁধে তুলে নিয়ে সাবিহাকে সাথে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যেতে লাগলো। সাবিহা বেজায় খুশি পানিতে না ফেলে তার অন্ধ শাশুড়ীকে জঙ্গলে ছেড়ে আসতে যাচ্ছে।

গহীন জঙ্গলের ভেতর বস্তাটা রেখে সাবিহা ও ফারুক বাড়ি রওনা দেয়৷
বাড়ি এসে সুখবর তার মাকে জানানোর জন্য দৌড়ে তার মায়ের রুমে ঢুকে সাবিহা।
গিয়ে দেখে মা কোথাও নেই। অমনি দরজায় দাঁড়ানো ফারুক অট্টহাসি দিয়ে বলতে থাকে "খুশি হওনি সাবিহা? তুমিই তো চেয়েছিলে বস্তা বেঁধে মাকে পানিতে ডুবিয়ে দিতে। আমি করুণা করে মারতে পারলাম না তাই জঙ্গলে ছেড়ে আসলাম।"

"আমার মা কোথায়? তুমি আমার মাকে রেখে এসেছো?" ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সাবিহা।

ফারুক সাবিহার গালে চড় দিয়ে বলে
" কেন মা বলতে আলাদা ছিলো নাকি? আমি তো তোমার মাকেও মা ভাবি আমার মাকেও মা ভাবি। এতটা পিলে চমকে উঠলো কেন তোমার? কী ভেবেছিলে আমার অন্ধ মাকে তুমি মে/রে ফেলবে? এখন কেমন লাগছে?"

সাবিহা পাগলের মতো মাটি হাতড়ে কাঁদছে ঠিক সেইসময় দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সাবিহার মা৷ চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে তার লজ্জায়। সাবিহা তার মাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে।  ফারুক তাদের উদ্দেশ্যে বলে "তোমরা অমানুষ বলে আমি অমানুষ হবো এমনটা না। আমি বস্তা করে মায়ের ছেড়া কাথা বালিশ ফেলে এসেছি। তোমার মাকে আমার মায়ের কাছেই রেখে গিয়েছি।  শুধু এটাই অনুভব করালাম সাবিহা, কারো মায়ের প্রতি অবিচার হলে তার কেমনটা লাগে! তুমি তোমার মায়ের সাথে কাল বাড়ি চলে যাবে। তোমার ভাইকে ফোন দিয়ে সব জানিয়ে দিয়েছি। আমি আমার মায়ের কাছে থাকবো,আমার মায়ের শেষ সময়টাতে আমিই তার সকল সেবা করবো খেয়াল রাখবো। তোমার মতো নোংরা মানসিকতার ছায়া যেনো আমার মায়ের ওপর না আসে"

সমাপ্ত

Post a Comment

Previous Post Next Post