জীবনে সব সিদ্ধান্ত কি বৈঠকে হয়




  জীবনে সব সিদ্ধান্ত কি  বৈঠকে হয়

 

আমাকে নিয়ে যখন প্রথম বৈঠক হয় তখন আমার বয়স সাড়ে চার বছর। মা মারা যাওয়ার দুইদিন পর। আমি দিদার শুকনো ত্রিফলার বক্সটায় ওগুলো মনোযোগ দিয়ে গুনছিলাম। হাতকাটা জামা আর দুইটা ঝুটি বেধে সেজেছিলাম।


মা এতদিন রাগ করে বাপের বাড়ি ছিলো। তাই আমি দাদু বাড়িতেই ছিলাম।

এখন মা মারা যাওয়ার কারণে ওদের সন্তান হিসেবে আমার ওখানে থাকাটায় স্বাভাবিক।  

দাদু দিদা সামান্য জোরে বললেও, মামারা পরবর্তী যাতে বলতে পারে তারা আমাকে পাঠিয়ে দেয় নি ওরা নিয়ে গিয়েছে,এইটুক বলার মতো বাধা দিয়েছিল।


আমি বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার খুশি ছিলাম। আমাদের বিশাল ঘরে আমার খেলনা, দোলনা, আর জামা কাপড় গুলো ফিরে পাব।


আমি সে ঘরে গিয়ে প্রথমে বুঝতে পারি নি কেন আমার এইটা আমার ঘর মনে হচ্ছে না।

মা না থাকলে যে কোন ঘরেই ঘর হয় না কেউ আমাকে বলতে হয় নি। শুধু বুঝতে শুরু করেছিলাম।


আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় বার বৈঠক হয় চার মাস পর। বাবার বিয়েতে আমাকে কে দেখাবে নাকি লুকিয়ে রাখবে সে নিয়ে বৈঠক বসেছিলো।


আমি এক মনে পুতুলের জামাটা খুলছিলাম আর পরাচ্ছিলাম।

বিয়ে হবে  শুনেই আমি বললাম,

-বাবা আমার কিন্তু লাল ফ্রক চাই।


বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,


- সবাই যাবে,  আর ও যাবে না?


তখন পিসি আমায় কোলে তুলে বলেছিলো, -তোমার লাল ফ্রক চাই?


আমি পুতুল দেখিয়ে বললাম- ঠিক এমন।


পিসি গালে হাত দিয়ে বলল,

-ঠিক আছে, দিব। এক শর্তে, যদি তুমি সেখানে বাবাকে বাবা না ডাক।


আমি বাবার দিকে তাকালাম, বাবা উঠে চলে গেল।

পিসি আমার গাল টিপে ঝুটি বেধে দিতে বলল,

-তোমাকে আমি লাল ফ্রক দিব,সবার সাথে সাজিয়ে দিব। যদি তুমি ওখানে বাবাকে বাবা না ডাক। নইলে কিন্তু আমরা সবাই চলে যাব তোমাকে বাথরুমে অন্ধকার করে ঘরে রেখে চলে যাব।


আমি সেদিন প্রথম জেনেছিলাম, কীভাবে কান্না আটকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে হয়৷


পিসি গালে চুমু খেতেই দৌঁড় দিয়েছিলাম। কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলাম আমার কান্না দেখাতে নেই কাউকে।

সেদিন প্রথম আমি জোরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম, মাকে ডেকেছিলাম। প্রথম অভিযোগ করেছিলাম।

-মা তুমি কোথায়?


এরপর আমাদের ঘরে বা আমার জীবনে যত কেউ আমাকে নিয়ে ভেবেছে বা আমাকে নিয়ে কথা হয়েছে তা শুধু আমাকে নিয়ে বসা বৈঠকেই হয়েছে।


নতুন মা আসার পর আমাকে নিয়ে আবার বৈঠক হল,

 বাবাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে মা। নতুন মায়ের বাবা আমেরিকার ভিসা দিয়েছে। আমাকে নেওয়ার প্রশ্নেই আসে না কারো। ইচ্ছে হওয়ার তো কথা না।


আমাকে মামার বাড়ি পাঠানোর জন্য আবার বৈঠক হল, তখন মামারা আটকালেও। এইবার তারা বাধা দিলো। কেন নেবে?  

কিছুদিন পর কত খরচ। কে নেবে এই দায়ভার?


দাদু একটু বলে উঠলেও,বড় মামীর  জোরালো কণ্ঠ দমিয়ে দিলো দাদুকে।


-কে নেবে এত খরচ?স্কুল, পড়ালেখা? একটা বাচ্চা খরচ চালানো কি সোজা?

মাসে মাসে খরচ না পাঠালে এই মেয়ে আমরা রাখবো না।


দাদু দিদা সায় দিলো। তবে দিদার কোলে বসে পানের ঘ্রানে কিছুটা নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছিলো।


মায়ের রুম টায় এখন মামাদের ছেলে মেয়েদের পড়ার রুম৷

আমি দাদু দিদার রুমেই থাকলাম। দাদু আর আমি খাটে ঘুমাতাম। দিদি নিচে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে ঘুমাতো।

আমি বড় হতে হতে আমি দিদির সাথে থাকতে শুরু করলাম ফ্লোরে। এরপর দিদাকে খাটে তুলে দিয়ে আমি ফ্লোরে ঘুমাতাম।

বাবা আসতো বছরে একবার। দেখা করতে অনেক গুলো জিনিস নিয়ে। আমার ভালোই লাগতো কেউ তো আসে।  

আমারো বাবা আছে। একবার হলেও ডাকতে পারি।

বলতে পারি আমার বাবা এসেছে। বাবা আরেক বার এসে বলল,বাবা আর আসবে না। কখন আসবে তার ঠিক নেই। উনার ছেলেমেয়ের এইখানের আবাহাওয়া স্যূট হয় না। পড়াশোনা শুরু হবে তাই ওরা আসবে না।

তবে আমার নামে একাউন্ট হয়েছে। মাসে মাসে টাকা চলে আসবে।  দাদু দেখবে সব।


আমি তখনো বুঝি নি বাবা কে আমি আর কখনো দেখব না।


আমি প্রথম বারের মতো বলেছিলাম, আমাকেও নিয়ে যাও।


বাবা কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা হাত রেখে কোন শব্দ না করে চলে গেল।


বাবার চেহেরাটা আর মনেই নেই। মামাদের মতো বাবাও কি বুড়া হয়েছিলো? চুল গুলো সাদাকালো হয়েছিল? জানা নেই। জানা হয় নি আর।

মা যেমন আমার কাছে চির সুন্দরী হয়ে রয়ে গেল ছবির মতো। বাবাও তেমন।


আমাকে নিয়ে কারো কোন চিন্তা কোন কালেই ছিল না। আমার নাম উচ্চারণ হতো কাজের সময়। আর বৈঠকে।


দাদু মারা যাওয়ার পর একাউন্ট কে দেখবে তা নিয়ে বসেছিল পরের বৈঠক।


বড় মামা দায়িত্ব নিলো। তবে আগের মতো বেতন গুলো দেওয়া হতো না প্রাইভেটের।

চাইতে গেলে বড় মামীই বলত,

-পড়াশোনায় তো ভালো, টিউশনি শুরু কর না। পড়ালেখায় ও সুবিধা হবে। হাত খরচ ও আসবে।


আইডিয়া খারাপ লাগে নি। শুরু করলাম ক্লাস টেন থেকে টিউশনি।


দিদা অসুস্থ হওয়ায় আমাকে নিয়ে  আবার বৈঠক হলো।


দিদা ও মারা গেলে  আমার কোন ব্যবস্থা করে না দিলে, দিদা মরেও শান্তি পাবে না।


তাই আমার ব্যবস্থা করা হলো। ইন্টারে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়ে গেল।


ভেবেছিলাম এইবার বোধহয় আমাকে নিয়ে বৈঠক বসা শেষ হবে। একজন কে তো পেলাম আমার বলার জন্য।

না আমার ভাগ্য এইটুক লেখা ছিলো না কিংবা বৈঠক আমার পিছু ছাড়লো না।


পড়াশোনা চালানোর ইচ্ছে ছিলো সেটা বলাতে শ্বশুর বাড়ি তে এসে  প্রথম বৈঠক হলো।


ইন্টার টা শেষ করার অনুমতি হলেও।  এরবেশি আর সুযোগ বা অনুমতি কোন টায় হয় নি।


বড় ছেলেটা হয়ে গেল। সে সবে মা বলা শুরু করেছিলো এরপর ছেলে আর মেয়ে একসাথে হয়ে গেল।


আমার আর অন্য কিছু ভাবার সুযোগ হয় নি।তবে ওদের মাঝে  নিজের অসুখী জীবনের সুখ  গুলো খোঁজা শুরু করলাম।  আমাকে নিয়ে বৈঠক হওয়া বন্ধ হয় নি।


ছেলেদের দোষ হলে আমার নামে বৈঠক হতো। স্বামী অন্য কারো বউয়ের সাথে বিছানায় ধরা খেলে আমার নামে বৈঠক  হতো।

সে যখন আমাকে মেরে বিছানায় ফেলে রেখে যেত তখন ও আমাকে নিয়েই বৈঠক হতো।


মাঝে মাঝে মায়ের মতো স্বার্থপর হতে ইচ্ছে হতো৷ যেভাবে মা আমাকে একা ফেলে আত্মহত্যা করেছিল। হ্যাঁ মা আমাকে ছেড়ে পালিয়েছিলো। আমারো ইচ্ছে হয়।


তবে আমার ছেলেমেয়ে গুলোকে আমি সেই সব বৈঠকে একবার করে চিন্তা করতেই, হাউমাউ করে  কাদঁতাম।  ওদের জন্য না। নিজের জন্য। নিজেকে দেখে। কতটা  একা আর অসহায় ছিলাম মা ছাড়া সেটা ভেবে এখনো তীরের মতো ফুটে রক্তক্ষরণ হয়।


ছেলে মেয়েদের নিয়ে আমি যত সুখী হওয়ার চেষ্টা করতাম ততবার এই বৈঠক যেন আমার পিছ ছাড়ে না।


জায়গায় জমি নিয়ে বৈঠকে মারামারি তে স্বামী মারা গেল।


বড় ছেলেটা তখন সবে ক্লাস এইটে।


না মায়ের মতো আমি পালিয়ে আসি নি। মায়ের তো জায়গায় ছিলো৷ তার মা বাবা ছিলো। ওরা তো আমার জন্য সে জায়গা করে যায় নি৷ লুকানোর জন্য হলেও।


এরপর যখন যখন বৈঠক হতো আমি জোর গলায় কথা বলতাম। নিজের জন্য বসা বৈঠক গুলোতে নিজের  অধিকার  গুলো নিয়ে কখনো বলতে না পারলেও ছেলেমেয়ের একটা অধিকার ও আমি ছাড়ব না বলেছিলাম।


আর যার ছোটবেলা কেটেছে বৈঠকে বৈঠকে সে আর কত ভয় পাবে বৈঠকে?


মাঝের একা জীবন টাকে আমাকে নিয়ে আর বৈঠক না হলেও।

ছেলেরা বড় হওয়ার পর আমাকে নিয়ে শুরু হলো আবার বৈঠক।


কে রাখবে আমায়?কে দেখবে আমায়?


ছেলে মেয়ের এইসব বৈঠকে নিজেকে আবার সেই ছোট্ট ফ্রকে ঝুটি বাধা মেয়ে মনে হয়।

যে আসলেই বুঝে নি এই বৈঠক কেন? সে তো মা বাবা দুজনেই চেয়েছিলো।

এই বৈঠক কেন? আমি তো ছেলেমেয়েদের একসাথেই চেয়েছি।


আমাকে নিয়ে আজ শেষ বৈঠক। হয়ত আজ আমার পিছু ছাড়বে এই বৈঠক।


না, মরার পরেও দেখলাম আমার শেষ কাজে দায়িত্ব কে নিবে কতটা নেবে?  আমি কার জন্য কি করে গেলাম তা নিয়ে বৈঠকের শেষ নেই।


আমার  শেষ নিঃশ্বাস টাও দীর্ঘশ্বাস হয়েই বের হয়েছিলো অনেক মেয়ের মতোই। যাদের জীবন টা কোন কালেই তাদের ছিলো না। তাদের জীবনে যত বার তাদের নাম উচ্চারণ হয়েছে তা হয়েছে বৈঠকে।

তাদের জীবন চলেছে এই বৈঠকের সিদ্ধান্তে।

যারা মানুষ নয়,  শুধু নারী হয়েই জম্মেছিলো।


 



Post a Comment

Previous Post Next Post